Slider 1 Slider 2 Slider 3 Slider 4

হাদিসের গল্পঃ পাহাড়ের গুহায় আঁটকে পড়া তিন যুবক



the_cave_beam_lead_my_way


একবার তিনজন লোক পথ চলছিল, এমন সময় তারা বৃষ্টিতে আক্রান্ত হ’ল। অতঃপর তারা এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিল। হঠাৎ পাহাড় হ’তে এক খন্ড পাথর পড়ে তাদের গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। তখন তারা একে অপরকে বলল, নিজেদের কৃত কিছু সৎকাজের কথা চিন্তা করে বের কর, যা আললাহর সন্তুষ্টির জন্য তোমরা করেছ এবং তার মাধ্যমে আললাহর নিকট দো‘আ কর। তাহ’লে হয়ত আল্লাহ্‌ তোমাদের উপর হ’তে পাথরটি সরিয়ে দিবেন।

তাদের একজন বলতে লাগল, হে আল্লাহ্‌! আমার আববা-আম্মা খুব বৃদ্ধ ছিলেন এবং আমার ছোট ছোট সন্তানও ছিল। আমি তাদের ভরণ-পোষণের জন্য পশু পালন করতাম। সন্ধ্যায় যখন আমি বাড়ি ফিরতাম তখন দুধ দোহন করতাম এবং আমার সন্তান্দের  আগে আমার আববা-আম্মাকে পান করাতাম। একদিন আমার ফিরতে দেরী হয় এবং সন্ধ্যা হওয়ার আগে আসতে পারলাম না। এসে দেখি তারা ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি দুধ দোহন করলাম, যেমন প্রতিদিন দোহন করি। তারপর আমি তাঁদের শিয়রে (দুধ নিয়ে) দাঁড়িয়ে রইলাম। তাদেরকে জাগানো আমি পছন্দ করিনি এবং তাদের আগে আমার বাচ্চাদেরকে পান করানোও সঙ্গত মনে করিনি। অথচ বাচ্চাগুলো দুধের জন্য আমার পায়ের কাছে পড়ে কান্নাকাটি করছিল। এভাবে ভোর হয়ে গেল। হে আল্লাহ্‌! আপনি জানেন আমি যদি শুধু আপনার সন্তুষ্টির জন্যই এ কাজটি করে থাকি তবে আপনি আমাদের হ’তে পাথরটা খানিক সরিয়ে দিন, যাতে আমরা আসমানটা দেখতে পাই। তখন আল্লাহ পাথরটাকে একটু সরিয়ে দিলেন এবং তারা আসমান দেখতে পেল।

দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ্‌! আমার এক চাচাতো বোন ছিল। পুরুষরা যেমন মহিলাদেরকে ভালবাসে,আমি   তাকে  তার চেয়েও অধিক ভালবাসতাম। একদিন আমি তার কাছে চেয়ে বসলাম (অর্থাৎ খারাপ কাজ করতে চাইলাম)। কিন্তু তা সে অস্বীকার করল যে পর্যন্ত না আমি তার জন্য একশ’ দিনার নিয়ে আসি। পরে চেষ্টা করে আমি তা যোগাড় করলাম (এবং তার কাছে এলাম)। যখন আমি তার দু’পায়ের মাঝে বসলাম (অর্থাৎ সম্ভোগ করতে তৈরী হলাম) তখন সে বলল, হে আললাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয়  কর। অন্যায়ভাবে মোহর (পর্দা) ছিঁড়ে দিয়ো না। (অর্থাৎ আমার সতীত্ব নষ্ট করো না)। তখন আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। হে আল্লাহ! আপনি জানেন আমি যদি শুধু আপনার সন্তুষ্টির জন্য এ কাজটি করে থাকি, তবে আপনি আমাদের জন্য পাথরটা সরিয়ে দিন। তখন পাথরটা কিছুটা সরে গেল।

তৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ্‌! আমি এক ‘ফারাক’ চাউলের বিনিময়ে একজন শ্রমিক নিযুক্ত করেছিলাম। যখন সে তার কাজ শেষ করল আমাকে বলল, আমার পাওনা দিয়ে দাও। আমি তাকে তার পাওনা দিতে গেলে সে তা নিল না। আমি তা দিয়ে কৃষি কাজ করতে লাগলাম এবং এর দ্বারা অনেক গরু ও তার রাখাল জমা করলাম। বেশ কিছু দিন পর সে আমার কাছে আসল এবং বলল, আল্লাহকে ভয় কর (আমার মজুরী দাও)। আমি বললাম, এই সব গরু ও রাখাল নিয়ে নাও। সে বলল, আল্লাহকে ভয় কর, আমার সাথে ঠাট্টা কর না। আমি বললাম, আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছি না, ঐগুলো নিয়ে নাও। তখন সে তা নিয়ে গেল। হে আল্লাহ! আপনি জানেন, যদি আমি আপনার সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ কাজটি করে থাকি, তবে পাথরের বাকীটুকু সরিয়ে দিন। তখন আল্লাহ পাথরটাকে সরিয়ে দিলেন।

[আব্দুললাহ  ইবনু  ওমর  (রাঃ)  হ’তে  বর্ণিত,  বুখারী  হা/২৩৩৩,  ‘চাষাবাদ’  অধ্যায়, অনুচেছদ-১৩; মুসলিম হা/২৭৪৩, মিশকাত হা/৪৯৩৮]।

শিক্ষা:

  • বান্দা সুখে-দুঃখে সর্বদা আল্লাহকে ডাকবে।
  • বিপদাপদের সময় আল্লাহকে ব্যতীত কোন মৃত ব্যক্তি বা অন্য কাউকে ডাকা শিরকে আকবর বা বড় শিরক।
  • সৎ আমলকে অসীলা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।
  • পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে হবে এবং স্ত্রী ও সন্তানদের উপর তাদেরকে প্রাধান্য দিতে হবে।
  • শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা প্রদান করতে হবে।
Source: quraneralo.com

হাদিসের গল্পঃ যমযম কূপ ও কাবা ঘর নির্মাণের ঘটনা





হযরত সাঈদ বিন জুবায়ের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,তিনি হযরত ইবনে আব্বাস  (রাঃ)  থেকে  বর্ণনা  করেন,একদা হযরত ইবরাহীম(আঃ)  শিশুপুত্র ইসমাঈল ও তাঁর মা হাযেরাকে নিয়ে বের হ’লেন  এমন অবস্থায় যে,হাযেরা তাকে দুধ পান করাতেন। অবশেষে যেখানে কা‘বাঘর অবস্থিত  ইবরাহীম (আঃ) তাঁদের উভয়কে সেখানে নিয়ে এসে মসজিদের উঁচু অংশে যমযম কূপের উপর অবস্থিত একটি বিরাট গাছের নীচে রাখলেন। সে সময় মক্কায় ছিল না কোন জন-মানব, ছিল না কোন পানির ব্যবস্থা। তিনি একটি থলিতে খেজুর ও একটি মশকে সামান্য পানিসহ তাদেরকে সেখানে রেখে ফিরে চললেন। তখন ইসমাঈল (আঃ)-এর মা পিছনে চলতে লাগলেন এবং বললেন,‘হে ইবরাহীম! এই উপত্যকায় আমাদের রেখে আপনি কোথায় যাচেছন?এখানে না আছে কোন মানুষ,না আছে পানাহারের ব্যবস্থা’। তিনি এ কথাটি তাঁকে বার বার বলতে থাকলেন। ইবরাহীম (আঃ) তাঁর কথায় কান না দিয়ে চলতেই থাকলেন। অতঃপর হযরত হাযেরা

জানতে চাইলেন,‘আল্লাহ কি আপনাকে এ কাজের নির্দেশ দিয়েছেন? তিনি বললেন,হ্যা। তখন হাযেরা বললেন,‘তাহ’লে আল্লাহ আমাদেরকে ধ্বংস করবেন না’।অতঃপর তিনি ফিরে আসলেন। আর ইবরাহীম (আঃ) সামনে চললেন।চলতে চলতে যখন তিনি গিরিপথের বাঁকে পৌঁছালেন,যেখান থেকে স্ত্রী-পুত্র তাকে দেখতে পাচেছ না। সে সময় তিনি কা‘বার দিকে মুখ করে দু’হাত তুলে এ দো‘আ করলেন, ‘হে প্রভু আমি আমার স্ত্রী ও পুত্রকে চাষাবাদহীন  বিরান  ভূমিতে  তোমার  সম্মানিত  গৃহের  সন্নিকটে  রেখে গেলাম। যাতে তারা ছালাত আদায় করতে পারে। তুমি কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও এবং তাদেরকে ফলাদি দারা রূযী দান কর, যাতে তারা তোমার শুকরিয়া আদায় করতে পারে।’ [ইবরাহীম ৩৭]

 (এ দো‘আ করে  ইবরাহীম (আঃ) চলে গেলেন)। আর ইসমাঈল (আঃ)- এর মা  তাঁকে তার বুকের দুধ পান করাতেন আর নিজে সেই মশক থেকে পানি পান করতেন। অবশেষে মশকের পানি ফুরিয়ে গেলে তিনি পিপাসিত হ’লেন এবং তাঁর শিশুপুত্রটিও পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ল।  তিনি শিশুটির দিকে দেখতে লাগলেন। তৃষ্ণায় তার বুক ধড়ফড় করছে অথবা বর্ণনাকারী বলেন,সে মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। শিশুপুত্রের এ করুণ অবস্থার প্রতি তাকানো অসহনীয়   হওয়ায়  তিনি  সরে  গেলেন  আর  তাঁর অবস্থানের  নিকটবর্তী পর্বত ‘ছাফা’-কে একমাত্র তাঁর নিকটতম পর্বত হিসাবে পেলেন। অতঃপর তিনি উপরে উঠে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় কি-না তা দেখতে লাগলেন। কাউকে না পেয়ে ছাফা পর্বত থেকে নেমে পড়লেন। এমনকি যখন তিনি নীচু ময়দান পর্যন্ত পৌঁউছালে, তখন তিনি তাঁর কামিজের এক প্রান্ত তুলে ধরে একজন ক্লান্ত-শ্রান্ত   মানুষের মতো ছুটে চললেন। অবশেষে ময়দান অতিক্রম করে ‘মারওয়া’ পাহাড়ের নিকট এসে তাঁর উপর উঠে দাঁড়ালেন। অতঃপর এদিকে সেদিকে তাকালেন,কাউকে দেখতে পান কি-না? কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলেন না। এমনিভাবে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করলেন।

 হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন,নবী করীম (সা:) বলেছেন: ‘এজন্যই মানুষ হজ্জ ও ওমরাহ্‌ এর সময় উক্ত পাহাড়দ্বয়ের মধ্যে সাতবার সাঈ করে থাকে’। এরপর তিনি যখন ‘মারওয়া’ পাহাড়ে উঠলেন,তখন একটি শব্দ শুনতে পেলেন এবং তিনি নিজেকেই নিজে বললেন,একটু অপেক্ষা কর।তিনি একাগ্রচিত্তে মনোযোগ দিয়ে শুনে বললেন,‘তুমি তো তোমার শব্দ শুনিয়েছ। তোমার কাছে কোন সাহায্যকারী থাকলে আমাকে সাহায্য কর’। অতঃপর তিনি যমযমের নিকট একজন ফেরেশতা দেখতে পেলেন। যিনি নিজের পায়ের গোড়ালি বা ডানা দ্বারা মাটিতে আঘাত করলেন, আর অমনি মাটি ফেটে পানি বের হ’তে লাগল। তখন হাযেরা (আঃ) চারপাশে নিজ হাতে বাঁধ দিয়ে একে হাউযের ন্যায় করে দিলেন এবং কোষ দ্বারা মশকটি ভরে নিলেন। কিন্তু তখনও পানি উপচে উঠতে থাকল।

হযরত  ইবনে  আব্বাস (রাঃ) বলেন,নবী  করীম (সা:)  বলেছেন: ‘ইসমাঈলের মাকে আল্লাহ রহম করুন! যদি তিনি বাঁধ না দিয়ে বা কোষে ভরে পানি মশকে জমা না করে যমযমকে ঐভাবে ছেড়ে দিতেন,তবে উহা একটি কূপ না হয়ে প্রবাহমান ঝর্ণায় পরিণত হ’ত’। রাবী বলেন, অতঃপর তিনি পান করলেন এবং তার পুত্রকে দুধ পান করালেন।

 ফেরেশতা তাকে (হাযেরা) বললেন,‘আপনি ধ্বংসের ভয় করবেন না। কারণ এখানে রয়েছে  আল্লাহর ঘর। এ শিশুটি এবং তার পিতা দু’জনে মিলে এখানে ঘর নির্মাণ করবে এবং আল্লাহ তাঁর  আপনজনকে ধ্বংস করবেন না’। ঐ সময় আল্লাহর ঘরের স্থানটি যমীন থেকে টিলার মত উঁচু  ছিল। বন্যা আসার ফলে তার ডানে বামে ভেঙ্গে যাচিছল। এরপর হাযেরা এভাবেই এখানে দিন যাপন করতে থাকেন।

 অতঃপর এক সময় ‘জুরহুম’ গোত্রের একদল লোক তাদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিল অথবা রাবী বলেন ‘জুরহুম’ পরিবারের কিছু লোক ‘কাদা’ নামক উঁচু ভূমির পথ ধরে এদিকে আসছিল। তারা মক্কার নীচু ভূমিতে অবতরণ করল এবং একঝাঁক পাখিকে চক্রাকারে উড়তে দেখতে পেল । তখন তারা বলল,নিশ্চয় এ পাখিগুলো পানির উপর উড়ছে। আমরা এ ময়দানের পথ হয়ে বহুবার অতিক্রম করেছি। কিন্তু এখানে কোন পানি ছিল না। তখন তারা একজন কি দু’জন লোক সেখানে পাঠালো। তারা সেখানে গিয়েই পানি দেখতে পেল। তারা সেখান থেকে ফিরে এসে সকলকে পানির সংবাদ দিল। সংবাদ শুনে সবাই সেদিকে অগ্রসর হ’ল। রাবী বলেন, ইসমাঈল (আঃ)-এর মা পানির নিকট ছিলেন। তারা তাঁকে বলল,আমরা আপনার  নিকটবর্তী স্থানে বসবাস  করতে  চাই।  আপনি  আমাদেরকে অনুমতি দিবেন কি? তিনি জবাব দিলেন,হ্যা। তবে,এ পানির উপর তোমাদের কোন অধিকার থাকবে না। তারা হ্যা বলে তাদের মত প্রকাশ করল।

 হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন,এ ঘটনা হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর মাকে মানুষের সাহচর্যে থাকার সুযোগ করে দিল। অতঃপর তারা সেখানে বসতি  স্থাপন  করল  এবং  তাদের  পরিবার-পরিজনের  নিকটও  সংবাদ পাঠাল। তারপর  তারাও  এসে  তাদের  সাথে  বসবাস  করতে  লাগল। অবশেষে সেখানে তাদেরও কয়েকটি পরিবারের বসতি স্থাপিত হ’ল। আর ইসমাঈল (আঃ)ও যৌবনে উপনীত হলেন এবং তাদের কাছ থেকে আরবী ভাষা শিখলেন। যৌবনে পদার্পণ   করে তিনি তাদের কাছে অধিক আকর্ষণীয় ও প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। অতঃপর যখন তিনি পূর্ণ যৌবন লাভ করলেন,তখন তারা তাদেরই একটি মেয়ের সাথে ইসমাঈল (আঃ)-এর বিবাহ দিলেন।ইতিমধ্যে হাযেরা মারা গেলেন।ইসমাঈলের বিবাহের পর ইবরাহীম (আঃ) তাঁর পরিত্যক্ত পরিজনের অবস্থা দেখার জন্য এখানে আসলেন। কিন্তু তিনি ইসমাঈল (আঃ)-কে পেলেন না।তিনি ইসমাঈল(আঃ)-এর স্ত্রীর নিকট তার অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলেন। পুত্রবধূ বলল, ‘তিনি আমাদের জীবিকার খোঁজে বেরিয়ে গেছেন। অতঃপর তিনি তাদের জীবিকা ও অবস্থা জানতে চাইলেন। তখন ইসমাঈলের স্ত্রী দুর্দশার অভিযোগ করে বলল,আমরা অতি দূরবস্থায়, অতি টানাটানি ও খুব কষ্টে আছি’। এ কথা শুনে ইবরাহীম (আঃ) বললেন,‘তোমার স্বামী বাড়ী আসলে আমার সালাম দিয়ে তার ঘরের চৌকাঠ বদলিয়ে নিতে বলবে’।

 এরপর যখন হযরত ইসমাঈল(আঃ) বাড়ী আসলেন,তখন যেন তিনি কিছু আঁচ করতে পারলেন। তিনি বললেন, তোমার নিকট কোন ব্যক্তি এসেছিল কি?স্ত্রী বলল,হ্যা। আমাদের নিকট এরূপ একজন বৃদ্ধ এসেছিলেন এবং আমাকে আপনার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিলেন। আমি তাকে আপনার খবর দেই। তিনি আমাদের জীবন-জীবিকা কিভাবে চলছে তা জিজ্ঞেস করেন। তখন আমি তাকে বলি,আমরা খুব কষ্টে ও অভাবে আছি। ইসমাঈল (আঃ) বললেন, তিনি কি তোমাকে কোন বিষয়ের অছিয়ত করেছেন? তিনি বললেন,হ্যা। তিনি তার সালাম আপনাকে দেয়ার নিদের্শ প্রদান করেছেন এবং বলেছেন,তোমার দরজার চৌকাঠ পরিবতর্ন করে নিও। ইসমাঈল  (আঃ)  বললেন,‘উনি  আমার  পিতা। তিনি  আমাকে তোমাকে      পৃথক   করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।তুমি তোমার আপনজনদের কাছে চলে যাও’। অতঃপর তিনি তাকে তালাক দিয়ে অপর একটি মেয়েকে বিবাহ করলেন।

 অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) এদের থেকে আল্লাহ যতদিন চাইলেন ততদিন দূরে থাকলেন। অতঃপর তিনি আবার তাদের দেখতে আসলেন। এবারেও তিনি পুত্রকে দেখতে পেলেন না। পুত্রবধূকে তার পুত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি উত্তর দিলেন,তিনি আমাদের জীবিকার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছেন। এরপর ইবরাহীম (আঃ) বললেন,তোমরা কেমন আছ? অতঃপর তিনি তাদের জীবন যাপন ও অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তিনি বললেন,আমরা ভাল ও সচছল আছি এবং তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন। ইবরাহীম (আঃ) জিজ্ঞেস করলেন,‘তোমাদের প্রধান খাদ্য কি? সে বলল,গোশত। তিনি আবার বললেন,‘তোমাদের পানীয় কি?সে বলল,পানি।ইবরাহীম (আঃ) দো‘আ করলেন,‘হে আল্লাহ্‌! তাদের গোশত ও পানিতে বরকত দিন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,তাদের জন্য তখন শস্য ছিল না। যদি থাকত তাহলে তিনি তাতে বরকত দানের জন্য দো‘আ করতেন। রাবী বলেন,মক্কা ব্যতীত অন্য কোথাও কেউ শুধু পানি ও গোশত দ্বারা জীবন ধারণ করতে পারে না। কেননা শুধু গোশত ও পানি জীবন যাপনের অনুকলূ হ’তে পারে না।

ইবরাহীম (আঃ) বললেন,‘তোমার স্বামী ঘরে ফিরে আসলে আমার সালাম দিয়ে তার ঘরের চৌকাঠ ঠিক রাখার কথা বলবে’। অতঃপর ইসমাঈল (আঃ) বাড়ী এসে বললেন, তোমাদের  নিকট কেউ এসেছিলেন কি?স্ত্রী বলল,হ্যা। একজন সুন্দর চেহারার বৃদ্ধ লোক এসেছিলেন এবং সে তাঁর প্রশংসা করল,তিনি আমাকে আপনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছেন। আমি তাঁকে আপনার সংবাদ জানিয়েছি। অতঃপর তিনি আমার নিকট আমাদের জীবন যাপন সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আমি তাঁ কে জানিয়েছি যে,আমরা ভাল আছি। ইসমাঈল (আঃ) বললেন, তিনি কি তোমাকে কোন বিষয়ের অছিয়ত করে গেছেন? সে বলল,হ্যা। তিনি আপনার প্রতি সালাম  জানিয়ে আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে,আপনি যেন আপনার ঘরের চৌকাঠ ঠিক রাখেন।  ইসমাঈল (আঃ) বললেন,ইনি আমার পিতা,আর তুমিআমার ঘরের চৌকাঠ। তিনি আমাকে  তোমাকে স্ত্রী হিসাবে বহাল রাখার নিদের্শ দিয়েছেন।

আল্লাহর ইচ্ছায় হযরত ইবরাহীম (আঃ) বহুদিন পর এসে দেখেন তার পুত্র যমযম কূপের নিকটে  একটি বড় গাছের নীচে বসে তীর মেরামত করছেন। পিতাকে দেখে তিনি দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন। অতঃপর পিতা ছেলের সাথে বা ছেলে পিতার সাথে সাক্ষাৎ হ’লে যেমন করে থাকে তাঁরা উভয়ে তাই করলেন। অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) বললেন,‘হে ইসমাঈল! আল্লাহ আমাকে একটি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। ইসমাঈল (আঃ) বললেন,আপনার প্রভু আপনাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা পালন করুন। তিনি বললেন, তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে? ইসমাঈল বললেন,আমি আপনাকে  সাহায্য  করব।  ইবরাহীম  (আঃ)  বললেন,আল্লাহ  এখানে  আমাকে একটি ঘর নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন। একথা বলে তিনি উঁচু  টিলাটির দিকে ইঙ্গিত করলেন যে,  এর চারপাশে ঘেরাও দিয়ে। তখনি বাপ-বেটা কা‘বাঘরের দেয়াল তুলতে লেগে গেলেন। ইসমাঈল (আঃ) পাথর আনতেন,আর ইবরাহীম (আঃ) নির্মাণ করতেন। পরিশেষে যখন দেওয়াল উঁচু হয়ে গেল,তখন ইসমাঈল (আঃ) (মাকবামে ইবরাহীম নামক) পাথরটি আনলেন এবং যথাস্থানে রাখলেন। ইবরাহীম (আঃ) তার উপর দাঁড়িয়ে নির্মাণ কাজ করতে লাগলেন। আর ইসমাঈল (আঃ) তাকে পাথর যোগান দিতে থাকেন। তারা উভয়ে আল্লাহর কাছে দো‘আ করলেন যে: ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এ কাজ কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞাত।’ [বাকবারাহ ১২৭] তাঁরা উভয়ে আবার কা‘বাঘর তৈরি করতে থাকেন এবং কা‘বাঘরের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে এ দো‘আ করতে থাকেন,‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদের পক্ষ থেকে কবলুকরুন। নিশ্চয়ই আপনি সবকিছু শুনেন ও জানেন’

 [বাকবারাহ ১২৭; ছহীহ বুখারী হা/৩৩৬৪ ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায়, অনুচেছদ-৯]।

 শিক্ষা:

  • আললাহর হুকুমকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁর সন্তুষ্টির জন্য প্রয়োজনে স্ত্রী-পুত্রসহ সবকিছু ত্যাগ করতে হবে।
  • সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকতে হবে ও তাঁর উপর ভরসা করতে হবে। কোন অবস্থাতেই ধৈর্যহারা হওয়া চলবে না।
  • পরিবার ও সন্তান সন্ততির জন্য দো‘আ করতে হবে।
  • একক নয়; বরং যৌথ উদ্যোগে সামাজিক কাজ সম্পাদন করতে হবে।
  • হাযেরার মতো সুদৃঢ় ঈমানের অধিকারীণী হওয়ার জন্য মা-বোনদের সচেষ্ট হ’তে হবে।
  • আল্লাহর আনুগত্য ও ধৈর্যের পরিণাম সর্বদা কল্যাণকরই হয়।
Source: quraneralo.com

হাদিসের গল্পঃ ঈমানদার যুবক ও আছহাবুল উখদূদের কাহিনী



alone-boy-ocean-sunrise-favim-com-112915


বহুকাল পূর্বে একজন রাজা ছিলেন। সেই রাজার ছিল একজন যাদকুর। ঐ যাদুকর বৃদ্ধ হ’লে একদিন সে রাজাকে বলল,‘আমি তো বৃদ্ধ হয়ে গেছি। সুতরাং আমার নিকট একটি ছেলে পাঠান, যাকে আমি যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিব’। বাদশাহ তার নিকট একটি বালককে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি তাকে যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিতে লাগলেন। বালকটি যাদুকরের নিকট যে পথ দিয়ে যাতায়াত করত, সে পথে ছিল এক সন্ন্যাসীর আস্তানা। বালকটি তার নিকট বসল এবং তার কথা শুনে মুগ্ধ  হ’ল। বালকটি যাদুকরের নিকট যাওয়ার সময় ঐ সন্ন্যাসীর নিকট বসে তাঁর কথা শুনত। ফলে যাদুকরের নিকট পৌছাতে বালকটির দেরী হ’ত বলে যাদুকর তাকে প্রহার করত। বালকটি সন্ন্যাসীর নিকট এ কথা জানালে তিনি বালককে শিখিয়ে দেন যে,তুমি যদি যাদুকর কে ভয় কর তাহ’লে বলবে, বাড়ীর লোকজন আমাকে পাঠাতে বিলম্ব  করেছে  এবং  বাড়ীর  লোকজনকে  ভয়  পেলে  বলবে, যাদুকরই আমাকে ছুটি দিতে বিলম্ব করেছে।

বালকটি এভাবে যাতায়াত করতে থাকে। একদিন পথে সে দেখল,একটি বৃহদাকার প্রাণী মানুষের চলাচলের পথ রোধ করে বসে আছে। বালকটি ভাবল, আজ পরীক্ষা করে দেখব যে, যাদুকর শ্রেষ্ঠ, না সন্ন্যাসী শ্রেষ্ঠ? অতঃপর সে একটি প্রস্তর খন্ড নিয়ে বলল, ‘হে আল্লাহ্‌! যাদুকরের কার্যকলাপ অপেক্ষা সন্ন্যাসীর কার্যকলাপ যদি তোমার নিকট অধিকতর প্রিয় হয়, তবে এই প্রাণীটিকে এই প্রস্তরাঘাতে মেরে ফেল। যেন লোকজন যাতায়াত করতে পারে’। এই বলে প্রাণীটিকে লক্ষ্য করে সে প্রস্তরখন্ডটি ছুঁড়ে মারল। প্রাণীটি ঐ প্রস্তাঘাতে মারা গেল এবং লোক চলাচল শুরু হল।

এরপর বালকটি সন্ন্যাসীর নিকট গিয়ে তাকে ঘটনাটি জানালে তিনি তাকে বললেন, বৎস! তুমি এখনই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছ। তোমার প্রকৃত স্বরূপ আমি বুঝতে পারছি। শীঘ্রই তোমাকে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। যদি তুমি পরীক্ষার সম্মুখীন হও তাহলে যেন আমার কথা প্রকাশ করে দিও না। বালকটির দোআয় জন্মান্ধ ব্যক্তি চক্ষুষ্মান হতে লাগল, কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি নিরাময় হতে লাগল এবং লোকজন অন্যান্য রোগ হতেও আরোগ্য লাভ করতে লাগল। এদিকে রাজার একজন সহচর অন্ধ হয়েছিল। সে বহু উপঢৌকন সহ বালকটির নিকট গিয়ে বলল, তুমি যদি আমাকে চক্ষুষ্মান করে দাও, তাহলে এ সবই তোমার।  বালকটি বলল, আমিতো কাউকে আরোগ্য করতে পারি না । বরং  রোগ ভাল করেন আল্লাহ্‌। অতএব আপনি যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন, তাহলে আমি আপনার রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহর  নিকটে  দোআ  করতে  পারি।  তাতে  তিনি  হয়ত  আপনাকে আরোগ্য দান করতে পারেন। ফলে লোকটি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনল। আল্লাহ তাকে আরোগ্য দান করলেন।

পূর্বের ন্যায় তিনি রাজার নিকটে গিয়ে বসলে রাজা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিল? সে বলল, ‘আমার রব’। রাজা বললেন, আমি ছাড়া তোমার রব আছে কি? সে বলল, ‘আমার ও আপনার উভয়ের রব আল্লাহ’। এতে রাজা তাকে ধরে তার উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। অবশেষে সে বালকটির নাম প্রকাশ করে দিল। অতঃপর বালকটিকে রাজদরবারে আনা হল। রাজা তাকে বললেন, বৎস!আমি জানতে পারলাম যে, তুমি তোমার যাদুর গুণে জনমান্ধ ও কুষ্ঠোব্যাধিগ্রস্ত লোকদের রোগ নিরাময় করছ এবং অন্যান্য কঠিন রোগও নিরাময় করে চলেছ। বালকটি বলল, আমি কাউকে রোগ মুক্ত করি না। রোগ মুক্ত করেন আল্লাহ। তখন রাজা তাকে পাকড়াও করে তার উপর উৎপীড়ন চালাতে থাকেন। এক পর্যায়ে সে সন্ন্যাসীর কথা প্রকাশ করে দিল। তখন সন্ন্যাসীকে ধরে আনা হ’ল এবং তাঁকে বলা হল, তুমি  তোমার ধর্ম পরিত্যাগ কর। কিন্তু সে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল। তখন রাজার আদেশক্রমে করাত নিয়ে আসা হলে তিনি তা তার মাথার মাঝখানে বসালেন এবং তাঁর মাথা ও শরীর চিরে দ্বিখন্ডিত করে ফেললেন। তারপর রাজার সহচরকে আনা হল এবং তাকেও তার ধর্ম ত্যাগ  করতে বলা হল। কিন্তু সেও অস্বীকৃতি জানালে তাকেও করাত দিয়ে চিরে দ্বিখন্ডিত করা হল।

তারপর বালকটিকে হাযির করে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলা হল। বালকটিও নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করল। তখন রাজা তাকে তার লোকজনের নিকট দিয়ে বললেন, তোমরা একে অমুক পাহাড়ে নিয়ে যাও এবং তাকে সঙ্গে করে পাহাড়ে আরোহণ করতে থাক। যখন তোমরা পাহাড়ের উচ্চশৃঙ্গে পৌঁছাবে, তখন তাকে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলবে। সে যদি অস্বীকার করে, তাহলে তোমরা তাকে সেখান থেকে নীচে ছুড়ে ফেলে দিবে। তারা বালকটিকে নিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠলে বালকটি দো‘আ করল, ‘হে আল্লাহ্‌! তোমার যেভাবে  ইচ্ছা হয়, সেভাবে তুমি আমাকে এদের কাছ থেকে রক্ষা কর।’ তৎক্ষণাৎ পাহাড়টি কম্পিত হয়ে উঠল এবং তারা নীচে পড়ে মারা গেল। আর বালকটি (সুস্থ দেহে) রাজার নিকট এসে উপস্থিত হল। রাজা তখন তাকে বললেন, ‘তোমার সঙ্গীদের কি  হল’? তখন সে বলল, আল্লাহই  আমাকে  তাদের  হাত  থেকে বাঁচিয়েছেন।

তারপর রাজা তাকে তার একদল লোকের নিকট সোপর্দ করে আদেশ দিলেন, ‘একে একটি বড় নৌকায় উঠিয়ে  নদীর মাঝখানে নিয়ে যাও। যদি সে নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করে, তো ভাল। নচেৎ তাকে নদীতে নিক্ষেপ কর।’ তারা বালকটিকে নিয়ে মাঝ নদীতে পৌঁছালে বালকটি পূর্বের ন্যায় দোআ করল, ‘হে আল্লাহ্‌! তোমার যেভাবে ইচছা হয়, সেভাবে তুমি আমাকে এদের হাত থেকে রক্ষা কর।’ এতে নৌকা ভীষণভাবে কাত হয়ে পড়ল। ফলে রাজার লোকজন নদীতে ডুবে মারা গেল। আর বালকটি (সুস্ত দেহে) রাজার নিকটে আসলে রাজা তাকে বললেন, তোমার সঙ্গীদের কি অবস্থা? সে বলল, আল্লাহ্‌ই আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এরপর সে রাজাকে বলল, ‘আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন আমাকে কোনভাবেই হত্যা করতে পারবেন না। যতক্ষণ না আমি যা বলব, আপনি তা করবেন। রাজা বললেন, ‘সেটা কি’? বালকটি বলল, ‘আপনি একটি বিসতীর্ণ মাঠে সকল লোককে হাযির করুন এবং সেই মাঠে খেজুরের একটি গুঁড়ি পুঁতে তার উপরিভাগে আমাকে বেঁধে রাখুন। তারপর আমার তূনীর হতে একটি তীর  নিয়ে  ধনুকে  সংযোজিত  করুন। তারপর (বালকটির রব আল্লাহর নামে) বলে আমার দিকে তীরটি নিক্ষেপ করুন। আপনি  যদি  এ  পন্থা অবলম্বন  করেন, তবেই  আমাকে  হত্যা  করতে পারবেন।

বালকের কথামত এক বিসতীর্ণ মাঠে রাজা সকল লোককে সমবেত করলেন এবং বালকটিকে একটি খেজুর গাছের গুঁড়ির উপরে বাঁধলেন। তারপর রাজা  বালকটির  তূনীর  হতে  একটি  তীর  নিয়ে  ধনুকের  মধ্যভাগে সংযোজিত করলেন। তারপর বলে বালকটির দিকে তীর নিক্ষেপ করলেন। তীরটি বালকের চোখ ও কানের মধ্যভাগে বিদ্ধ হল। বালকটি এক হাতে তীরবিদ্ধ স্থানটি চেপে ধরল। অতঃপর সে মারা গেল।

এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত জনগণ বলে উঠল, ‘আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম।  আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। তারপর রাজার লোকজন তাঁর নিকট গিয়ে বলল, ‘আপনি যা আশঙ্কা করছিলেন তাই শেষ পর্যন্ত ঘটে গেল। সব লোক বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনল।’ তখন রাজা রাস্তাগুলির চৌমাথায় প্রকান্ড গর্ত খনন করার নির্দেশ দিলেন। তার কথা মতো গর্ত খনন করে তাতে আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হ’ল। তারপর রাজা হুকুম দিলেন, ‘যে ব্যক্তি বালকের ধর্ম পরিত্যাগ করবে না, তাকে ঐ আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মার। অথবা তাকে বলবে, তুমি এই আগুনে ঝাঁপ দাও। রাজার লোকেরা তার হুকমু পালন  করতে  লাগল। ইতিমধ্যে  একজন  রমণীকে  তার  শিশুসন্তাসহ উপস্থিত করা হল। রমণীটি আগুনে ঝাঁপ দিতে ইতস্তত করতে থাকলে শিশুটি বলে উঠল, ‘মা ছবর অবলম্বন (করতঃ আগুনে প্রবেশ) করুন।কেননা আপনি হক পথে আছেন’।

পবিত্র কুরআনের সূরা বুরূজে এ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে: “ধবংস হয়েছিল গর্তওয়ালারা- ইন্ধনপূর্ণ যে গর্তে ছিল অগ্নি, যখন তারা তার পাশে উপবিষ্ট ছিল এবং তারা মুমিনদের সাথে যা করছিল তা প্রত্যক্ষ করছিল। তারা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধু একারনে যে, তারা বিশ্বাস করতো পরাক্রমশালী ও প্রশংসার্হ আল্লাহে।” [বুরূজ ৪-৮]

[সহীহ মুসলিম হা/৩০০৫ ‘যুহদ ও রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, অনুচেছদ-১৭, শুহাইব বিন সিনান আর-রূমী (রাঃ) হতে বর্ণিত, আহমাদ হা/২৩৯৭৬]।


শিক্ষা :

  • প্রত্যেকটি আদম সন্তান স্বভাবধর্ম ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে।
  • মুমিন বান্দা সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করবে ও কায়মনোবাক্যে তাঁর নিকট দো‘আ করবে।
  • রোগমুক্তির মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌; কোন পীর-ফকীর বা সাধু-সন্ন্যাসী নয়।
  • আল্লাহর পথের নির্ভীক সৈনিকেরা বাতিলের সামনে কখনো মাথা নত করে না।
  • মুমিন দুনিয়াবী জীবনে পদে পদে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তার ঈমানের মযবূতী পরখ করেন।
  • হক্বের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
Source: quraneralo.com

হাদিসের গল্পঃ কা‘ব বিন আশরাফের মৃত্যুকাহিনী






জাবির বিন আব্দুললাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা রাসূলুললাহ্ (ﷺ) বললেন,কা‘ব ইবনু আশরাফকে হত্যা করার জন্য কে প্রস্তুত আছ? কেননা সে আললাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দিয়েছে। মুহাম্মদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) দাঁড়ালেন এবং বললেন, হে আললাহর রাসূল! আপনি কি চান যে, আমি তাকে হত্যা করি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, তাহলে আমাকে কিছু প্রতারণাময় কথা বলার অনুমতি দিন। রাসূলুললাহ (ﷺ)  বললেন, হ্যাঁ বল। এরপর মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) কা‘ব ইবনু আশরাফের নিকট গিয়ে বললেন, এ লোকটি [রাসলূ (ﷺ)] সাদাকা চায় এবং সে আমাদেরকে বহু কষ্টে ফেলেছে। তাই আমি আপনার নিকট কিছু ঋণের জন্য এসেছি। কা‘ব ইবনু আশরাফ বলল, আল্লাহর কসম!  পরে সে তোমাদেরকে আরো বিরক্ত ও অতিষ্ঠ করে তুলবে। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, আমরা তাঁর অনুসরণ করছি। পরিণাম কি দাঁড়ায় তা না দেখে এখনই তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করা ভাল মনে করছি না। এখন আমি আপনার কাছে এক ওসাক বা দুই ওসাক খাদ্য ধার চাই। কা‘ব ইবনু আশরাফ বলল, ধার তো পাবে তবে কিছু বন্ধক রাখ।

মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, কি জিনিস আপনি বন্ধক চান? সে বলল, তোমাদের স্ত্রীদেরকে বন্ধক রাখ। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ বললেন, আপনি আরবের একজন সুদর্শন ব্যক্তি। আপনার নিকট কিভাবে আমাদের স্ত্রীদেরকে বন্ধক রাখব? তখন সে বলল, তাহলে তোমাদের সন্তানদেরকে বন্ধক রাখ।  তিনি বললেন, আমাদের পুত্র সন্তানদেরকে আপনার নিকট কি করে বন্ধক রাখি? তাদেরকে এ বলে সমালোচনা করা হবে যে,মাত্র এক ওসাক বা দুই ওসাকের বিনিময়ে বন্ধক রাখা হয়েছে। এটা তো আমাদের জন্য খুব লজ্জাজনক বিষয়। তবে আমরা আপনার নিকট অস্ত্রশস্ত্র বন্ধক  রাখতে পারি। শেষে তিনি (মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ) তার কাছে আবার যাওয়ার ওয়াদা করে চলে আসলেন।

এরপর তিনি কা‘ব ইবনু আশরাফের দুধ ভাই আবূ নায়েলাকে সঙ্গে করে রাতের বেলা তার নিকট গেলেন। কা‘ব তাদেরকে দূর্গের মধ্যে ডেকে নিল এবং সে নিজে উপর তলা থেকে নিচে নেমে আসার জন্য প্রস্তুত হ’ল। তখন তার স্ত্রী বলল, এ সময় তুমি কোথায় যাচ্ছ? সে বলল, এই তো মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ এবং আমার ভাই আবূ নায়েলা এসেছে। ‘আমর ব্যতীত বর্ণনাকারীগণ বলেন যে, কা‘বের স্ত্রী বলল, আমি তো এমনই একটি ডাক শুনতে পাচ্ছি যার থেকে রক্তের ফোঁটা ঝরছে বলে আমার মনে হচ্ছে।

কা‘ব ইবনু আশরাফ বলল, মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ এবং দুধ ভাই আবূ নায়েলা (অপরিচিত কোন লোক তো নয়)। ভদ্র মানুষকে রাতের বেলা বর্শা বিদ্ধ করার জন্য ডাকলে তার যাওয়া উচিত। (বর্ণনাকারী বলেন) মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) সঙ্গে আরো দুই ব্যক্তিকে নিয়ে সেখানে গেলেন।

সুফইয়ানকে  জিজ্ঞেস  করা  হয়েছিল  যে,  ‘আমর কি তাদের দু’জনের নাম উল্লেখ করেছিলেন? উত্তরে সুফিয়ান বললেন, একজনের নাম উল্লেখ করেছিলেন। ‘আমর বর্ণনা করেন যে,তিনি আরো দু’জন মানষু সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তিনি বলেছিলেন, যখন সে (কা‘ব ইবনু আশরাফ)  আসবে।  ‘আমর  ব্যতীত  অন্যান্য  রাবীগণ  (মুহাম্মাদ  ইবনু মাসলামার সাথীদের সম্পর্কে) বলেছেন যে, (তারা হ’লেন) আবূ আবস্ ইবনু  জাবর,  হারিছ  ইবনু  আওস  এবং  আববাদ ইবনু  বিশর।

‘আমর বলেছেন, তিনি অপর দুই  লোককে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন এবং তাদেরকে বলেছিলেন, যখন সে আসবে তখন আমি তার মাথার চুল ধরে শুঁকতে থাকব। যখন তোমরা আমাকে দেখবে যে, খুব শক্তভাবে আমি তার মাথা আঁকড়িয়ে ধরেছি, তখন তোমরা তরবারি দ্বারা তাকে আঘাত করবে। তিনি  (মুহাম্মাদ  ইবনু  মাসলামাহ)  একবার  বলেছিলেন  যে, আমি তোমাদেরকেও শুঁকাব। সে (কা‘ব) চাদর নিয়ে নীচে নেমে আসলে তার শরীর থেকে সুঘ্রাণ বের হচ্ছিল। তখন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন,আজকের মত এতো উত্তম সুগন্ধি আমি আর কখনো দেখিনি।

‘আমর ব্যতীত অন্যান্য রাবীগণ বর্ণনা করেছেন যে, কা‘ব বলল, আমার নিকট আরবের সম্ভ্রান্ত ও মর্যাদাসম্পন্ন সুগন্ধী ব্যবহারকারী মহিলা আছে। ‘আমর বলেন, মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, আমাকে আপনার মাথা শুঁকতে অনুমতি দেবেন কি? সে বলল, হ্যাঁ। এরপর তিনি তার মাথা শুঁকলেন এবং এরপর তার সাথীদেরকে শুঁকালেন। তারপর তিনি আবার বললেন, ‘আমাকে আবার শুকঁবার অনুমতি দেবেন কি? সে বলল, হ্যা। এরপর তিনি তাকে কাবু করে ধরে সাথীদেরকে বললেন, তোমরা তাকে হত্যা কর। তাঁরা তাকে হত্যা করলেন। এরপর নবী (ﷺ)-এর নিকট এসে এ খবর দিলেন। [বুখারী হা/৪০৩৭ ‘মাগাযী’ অধ্যায়, ‘কা‘ব ইবনু আশরাফের হত্যা’ অনুচেছদ, মুসলিম হা/১৮০১]

শিক্ষা:

  • রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ভালবাসা ব্যতীত মুমিন হওয়া যাবে না।
  • পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
Source: quraneralo.com

হাদিসের গল্পঃ কা‘ব বিন মালিক (রাঃ)-এর তওবা






আব্দুর রহমান বিন আব্দুল্লাহ বিন কা‘ব বিন মালিক (রাঃ) থেকে বণির্ত,কা‘ব বিন মালিকের  পুত্রদের মধ্যে আব্দুল্লাহ তাঁর পিতা কা‘ব (রাঃ) অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর সাহায্যকারী ও  পথপ্রদর্শনকারী ছিলেন। আব্দুল্লাহ বলেন,‘আমি কা‘ব বিন মালিককে তাঁর তাবূক যুদ্ধে পেছনে  থেকে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করতে শুনেছি’।কা‘ব  (রাঃ)  বলেন,‘রাসূলুল্লাহ (সা:) যতগুলো যুদ্ধ করেছেন, তার মধ্যে তাবূক ও বদর ছাড়া আর কোন যুদ্ধেই আমি অনুপস্থিত থাকিনি। তবে বদর যুদ্ধে যারা পেছনে থেকে গিয়েছিলেন,তাদের কাউকে তিনি ভৎর্সনা করেননি। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা:) শুধুমাত্র একটি কুরাইশ কাফেলার সন্ধানে বের হয়েছিলেন । অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের ও শত্রুদের মাঝে অঘোষিত এ যুদ্ধ সংঘটিত করেন। আর আকাবার রাতে আমি রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি তখন ইসলামের উপর দৃঢ়ভাবে কায়েম থাকার জন্য আমাদের কাছ থেকে শপথ গ্রহণ করেন। তাই আমি আকাবার বায়‘আতের চেয়ে বদরের যুদ্ধকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করতাম না। যদিও মানুষের মাঝে আকাবার ঘটনা অপেক্ষা বদর যুদ্ধ অধিক প্রসিদ্ধ ছিল।

যাহোক আমার ঘটনা এই যে,আমি যখন তাবূকের যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলাম,সে সময়ের চেয়ে অন্য কোন সময়েই আমি অধিক শক্তিশালী ও সচছল ছিলাম না। আললাহর কসম! ইতিপূর্বে  আমার কাছে কখনো একসাথে দু’টো সওয়ারী ছিল না। অথচ এ যুদ্ধের সময় (যুদ্ধের পূর্বে) আমি তা সংগ্রহ করেছিলাম। আর রাসূলুল্লাহ (সা:) যখনই কোন যুদ্ধের ইচছা করতেন,তখন (যাতে শত্রুরা বুঝতে না পারে) সেজন্য বিপরীত পন্থা অবলম্বন করতেন। কিন্তু এ যুদ্ধের সময় যখন আসল,তখন ছিল ভীষণ গরম। পথ ছিল দীর্ঘ এবং স্থান ছিল বিশাল মরুভূমি। আর শত্রুর সংখ্যাও ছিল অনেক বেশি। কাজেই রাসূলুল্লাহ (সা:) যেদিকে যাত্রা করবেন,তা বলে দিলেন।যাতে তারা তাদের যুদ্ধের সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। তখন তার সাথে বিপুলসংখ্যক মুসলমান ছিলেন। তবে তাঁদের নাম কোন রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ ছিল না।

কা‘ব (রাঃ) বলেন,ফলে যদি কেউ যুদ্ধে না যাওয়ার ইচছা পোষণ করত,তাহ’লে সহজেই তা করতে পারত,যতক্ষণ না তার বিষয়ে অহি নাযিল হয়। রাসূলুল্লাহ (সা:) এমন এক সময় এ  অভিযান শুরু করেছিলেন,যখন ফলমূল পাকার ও গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়ার সময় ছিল। রাসূল (সা:) এবং তাঁর সাথে সকল মুসলমান যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচিছলেন। আমিও প্রত্যহ সকালে তাঁদের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। কিন্তু ফিরে এসে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। শুধু মনে মনে বলতাম, ‘আমি তো যে কোন সময় প্রস্তুত হওয়ার ক্ষমতা রাখি। এভাবে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে আমার সময় কেটে যেতে লাগল। পক্ষান্তরে লোকেরা পুরোদমে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল।

একদিন সকালে রাসূলুল্লাহ (সা:) মুসলমানদের নিয়ে রওয়ানা দিলেন। অথচ তখনো আমি কোন   প্রকার প্রস্তুতি নেইনি। মনে মনে ভাবলাম,‘দু’এক দিন পরে প্রস্তুতি নিয়েও তাঁদের সঙ্গে মিলিত  হ’তে পারব’। তারা চলে যাওয়ার পর একদা আমি মসজিদে গেলাম এবং প্রস্তুতি নেওয়ার পরিকল্পনা করলাম কিন্তু সিদ্ধান্তহীনভাবে ফিরে আসলাম। পরদিন সকালে যাওয়ার নিয়ত করলাম,কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত না নিয়েই ফিরে আসলাম। আমার এ দোদুল্যমনতার মাঝে মুসলিম সেনারা দ্রুত চলছিলেন এবং বহুদূর চলে গেলেন। আর আমি রওনা দিয়ে তাঁদের ধরে ফেলার ইচছা পোষণ করতে থাকলাম। আফসোস! আমি যদি এমনটি করে ফেলতাম (তাহ’লে ভালই হ’ত)! কিন্তু তা আমার ভাগ্যে ছিল না। রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর চলে যাওয়ার পর আমি যখন বাইরে  বের হ’তাম,তখন পথে-ঘাটে মুনাফিকদেরকে অথবা  দুর্বল  হওয়ার  কারণে  আল্লাহ যাদেরকে অক্ষম করে  দিয়েছেন,তাদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখতে পেতাম না। আর এটা আমাকে চিন্তান্বিত করে তুলত।

রাসূলুল্লাহ (সা:) তাবূকে পৌঁছার আগে পর্যন্ত আমার কথা জিজ্ঞেস করলেন না,তবে তাবূকে  পৌঁছে যখন তিনি সবাইকে নিয়ে বসলেন,তখন জিজ্ঞেস করলেন,‘কা‘বের কি হ’ল’? বনী সালামার একজন ব্যক্তি বললেন,‘হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! তাঁর বসন-ভূষণ ও অহংকারই তাঁকে  বাধা দিয়েছে’। মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বললেন,‘তুমি নিতান্তই বাজে কথা বললে। আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! আমরা তার ব্যাপারে ভাল বৈ আর কিছুই জানি না’। এতদশ্রবণে রাসূলুল্লাহ (সা:) চুপ করে থাকলেন। কা‘ব বিন মালিক (রাঃ) বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে অবহিত হ’লাম,তখন আমি ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। ভাবতে লাগলাম,  কোন  মিথ্যা  তালবাহানা  করা  যায়  কি-না? যার  মাধ্যমে আগামীকাল আমি তাঁর ক্রোধ থেকে  বাঁচতে পারি। এ ব্যাপারে পরিবারের কিছু বিচক্ষণ ব্যক্তির পরামর্শও চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন বলা হ’ল যে,রাসূলুল্লাহ (সা:) মদীনার একেবারে নিকটে এসে পৌঁছে গেছেন,তখন আমার মন থেকে বাতিল ধ্যান-ধারণা বিদূরিত হয়ে গেল। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে,তাঁর নিকট মিথ্যা বলে আমি মুক্তি পাব না। সুতরাং সত্য বলার জন্য দৃঢ়প্রত্যয়ী হ’লাম।

সকালে রাসূলুল্লাহ (সা:) মদীনায় পৌঁছে গেলেন। আর তাঁর নিয়ম ছিল যখনই তিনি সফর থেকে ফিরে আসতেন,প্রথমে মসজিদে যেতেন এবং সেখানে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন। তারপর লোকদের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য বসে যেতেন। যখন তিনি ছালাত শেষ করে (মসজিদে নববীতে) বসে গেলেন,তখন তাবূক যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে থাকা লোকেরা আসতে লাগল। তাঁরা হলফ করে নিজেদের ওযর পেশ করতে লাগল। এদের সংখ্যা ছিল আশির ঊধের্ব। বাহ্যিক অবস্থার বিচারে রাসূলুললাহ (সা:) তাদের ওযর কবুল করতঃ তাদের কাছ থেকে পুনরায় বায়‘আত নিয়ে তাদের মাগফিরাতের জন্য দো‘আ করলেন এবং তাদের মনের গোপন বিষয় আল্লাহর নিকট সোপর্দ করলেন।

কা‘ব (রাঃ) বলেন,‘আমিও আসলাম তার কাছে। আমি সালাম দিতেই তিনি বিরাগমিশ্রিত মুচকি হেসে বললেন,‘এস এস’। আমি গিয়ে তাঁর সামনে বসে পড়লাম। অতঃপর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস  করলেন,‘কি কারণে তুমি পিছনে পড়ে থাকলে? তুমি কি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বাহন ক্রয় করনি’? আমি বললাম হ্যাঁ,ক্রয় করেছি’। আরো বললাম,‘আল্লাহর কসম! যদি আমি আপনার  সামনে না বসে দুনিয়ার অন্য কোন লোকের সামনে বসতাম,তাহ’লে  আমি নিশ্চিত  যে,যে কোন ওযর পেশ  করে  তাঁর ক্রোধকে নির্বাপিত করতে পারতাম। আর আমি তর্কে পটু। কিন্তু আল্লাহর

শপথ! আমি জানি,আজ যদি আপনার কাছে মিথ্যা বলে আপনাকে খুশী করে যায়,তাহ’লে অচিরেই আল্লাহ্‌ আপনাকে আমার উপর ক্রদ্ধ করে দিবেন। আর যদি আজ আপনার সাথে সত্য কথা বলে যাই,তাতে আপনি নাখোশ হ’লেও আল্লাহর ক্ষমা লাভের আশা করা যায়। আল্লাহর কসম! আমার কোন ওযর ছিল না। আল্লাহর কসম! আমি যখন (অর্থাৎ তাবূক যুদ্ধে) আপনাদের থেকে পিছনে থেকে যাই,তখনকার মত আর কোন সময় আমি ততটা শক্তি-সামর্থ্যের ও সচছলতার অধিকারী ছিলাম না’। একথা শুনে রাসূলুললাহ (সা:) বললেন,‘যদি আসলে এরূপ হয়,তবে কা‘ব সত্য বলেছে। ঠিক আছে,চলে যাও, দেখ আল্লাহ তোমার ব্যাপারে কি ফায়ছালা দেন’।

আমি উঠে পড়লাম। বনী সালামার কিছু লোক আমাকে অনুসরণ করতে লাগল। তারা আমাকে বলল, আল্লাহর কসম! ইতিপূর্বে তুমিকোন পাপ করেছ বলে তো আমরা জানি না। পেছনে থেকে যাওয়া অন্যান্য লোকদের মত তুমি রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর নিকট একটা বাহানা পেশ করতে পারলে না? তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ক্ষমা প্রার্থনাই তোমার পাপ মোচনের জন্য যথেষ্ট হয়ে যেত। তারা আমাকে এমনভাবে তিরস্কার করতে লাগল  যে,একপর্যায়ে আমি রাসলূলুল্লা (সা:)-এর কাছে ফিরে গিয়ে আমার প্রথম কথাটিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার মনস্থ  করলাম। অতঃপর তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম,‘আচছা আমার মতো নিজের ভুল স্বীকার করেছে এমন আর কাউকেও কি তোমরা সেখানে দেখেছ’? তারা জবাব দিল,‘হ্যাঁ ,আরো দু’জন লোককে আমরা দেখেছি, যারা তোমার মত একই কথা বলেছে।আর তাদেরকেও তোমার মতো সেই একই কথা বলা হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,তারা কারা? লোকেরা জবাব দিল,তারা দু’জন হচেছন মুরারাহ বিন রাবী আল-‘আমরী এবং হিলাল বিন উমাইয়া আল-ওয়াকেফী। তারা আমার কাছে এমন দু’জন সৎ লোকের কথা বললেন, যাঁরা বদর যুদ্ধ অংশ গ্রহণ করেছিলেন  এবং আদর্শস্থানীয় ছিলেন। তাঁদের দু’জনের কথা শুনে আমি চলতে শুরু করলাম।

এদিকে রাসূলুল্লাহ (সা:) পেছনে থেকে যাওয়া লোকদের মধ্য থেকে আমাদের এ তিনজনের সাথে কথা বলা সমস্ত  মুসলমানের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছেন। কাজেই লোকেরা আমাদেরকে এড়িয়ে চলতে লাগল এবং আমাদের  প্রতি তাদের আচরণ পরিবর্তন করে ফেলল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হ’তে লাগল যে,চিরচেনা দুনিয়া যেন অচেনা হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আমরা ৫০ রাত অতিবাহিত করলাম। আমার সাথীদ্বয় নীরব হয়ে ঘরের মধ্যে বসে গেলেন এবং কান্নাকাটি করতে লাগলেন। তবে আমি ছিলাম খুব শক্তিশালী ও ধৈর্যশীল যুবক। তাই আমি বাইরে বের হয়ে

মুসলমানদের সাথে ছালাতে যোগ দিতাম এবং বাজারে ঘুরাফিরা করতাম। কিন্তু কেউ আমার সাথে কথা বলত না। আমি রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর কাছে আসতাম। তিনি যখন ছালাতের পর  মজলিসে বসতেন, আমি তাঁকে সালাম দিতাম। আমি মনে মনে বলতাম,আমার সালামের জবাবে তাঁর ঠোঁট নড়ল কি নড়ল না? তারপর আমি তাঁর সন্নিকটে ছালাত আদায় করতাম। আমি  আড়চোখে লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁকে দেখতাম। কাজেই দেখতে পেতাম যে,যখন আমি ছালাতে মশগূল থাকি, তখন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আবার আমি যখন তাঁর দিকে দৃষ্টি দিতাম, তখন তিনি মুখ ফিরিয়ে নিতেন। এভাবে আমার প্রতি লোকদের কঠোরতা ও এড়িয়ে চলা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকল।

একদিন আমার চাচাত ভাই আবূ ক্বাতাদাহর বাগানের প্রাচীর টপকে তার কাছে আসলাম। সে  ছিল আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। আমি তাকে সালাম দিলাম। কিন্তু আল্লাহর কসম! সে আমার সালামের জবাব দিল না। আমি তাকে  বললাম,হে  আবূ  ক্বাতাদাহ!  আল্লাহর দোহায়  দিয়ে  তোমাকে জিজ্ঞেস করি,তুমি কি জান না,আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা:)-কে ভালবাসি? সে চুপ করে থাকল। আমি আবার আল্লাহর নামে কসম  করে  তাকে এ প্রশ্ন করলাম। এবারও সে চুপ করে থাকল। আমি তৃতীয়বার তাকে একই প্রশ্ন করলাম। এবার সে জবাব দিল,’(এ ব্যাপারে) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন’। (এতদশ্রবণে) আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। অতঃপর প্রাচীর টপকে পুনরায় ফিরে এলাম।

কা‘ব  বলেন,ইত্যবসরে একদিন আমি মদীনার বাজারে  হাঁটছিলাম। সিরিয়ার একজন খৃষ্টান  কৃষক মদীনার বাজারে খাদ্যশস্য বিক্রি করতে এসেছিল। সে লোকদেরকে জিজ্ঞেস করছিল, কে আমাকে কা‘ব বিন মালিকের ঠিকানা বলে দিতে পারে? তখন লোকেরা তাকে ইশারা করে দেখিয়ে দিল। সে আমার কাছে এসে গাসসানের রাজার একটি চিঠি আমার হাতে অর্পণ করল। তাতে লেখা ছিল,‘পর সমাচার এই যে,আমি জানতে পেরেছি আপনার সাথী  আপনার  উপর  যুলুম  করেছেন। অথচ আল্লাহ আপনাকে লাঞ্ছনা ও অবমাননাকর অবস্থায় রাখেননি। আপনি আমাদের এখানে চলে আসুন। আমরা আপনাকে সাহায্য-সহযোগিতা করব’। চিঠিটা পড়ে আমি বললাম, এটাও আর একটি পরীক্ষা। কাজেই আমি চুলা খুঁজে চিঠিটা আগুনে জ্বালিয়ে দিলাম।

এভাবে ৫০ দিনের মধ্যে ৪০ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। এমন সময় আমার কাছে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর একজন দূত এসে বললেন,রাসূল (সা:) তোমাকে তোমার স্ত্রী থেকে পৃথক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি বললাম,আমি কি তাকে তালাক দিব,না কি করব? তিনি বললেন, না, তালাক দিবে না। বরং তার থেকে পৃথক থাকবে এবং তার কাছে ঘেঁষবে না। আমার অন্য দু’জন সাথীর কাছেও এ মর্মে দূত পাঠানো হ’ল। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, তুমি তোমার পরিবারের কাছে চলে যাও। আর আল্লাহ আমার এ ব্যাপারে কোন ফায়ছালা না দেওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে অবস্থান কর।

কা‘ব (রাঃ) বলেন, হিলাল বিন উমাইয়ার স্ত্রী রাসূল (সা:)-এর কাছে এসে বললেন,হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! হিলাল বিন উমাইয়া অতিশয় বৃদ্ধ। তার কোন সেবক নেই। যদি আমি তার সেবা করি, তবে কি আপনি অপছন্দ করবেন? তিনি জবাব দিলেন,না,তবে সে যেন তোমার কাছে না ঘেঁষে।  তিনি  বললেন,আল্লাহর  কসম! তার মধ্যে এ কাজের প্রতি উৎসাহবোধ-ই নেই। আল্লাহর কসম! যেদিন থেকে এ ঘটনা ঘটেছে সেদিন থেকে অদ্যাবধি সে কাঁদছে।

 কা‘ব (রাঃ) বলেন,আমাকেও আমার পরিবারের কেউ কেউ বলল,তুমিও তোমার স্ত্রীর ব্যাপারে রাসূল (সা:)-এর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এস,যাতে সে তোমার সেবা করতে পারে, যেমন হিলাল বিন উমাইয়ার স্ত্রী তার স্বামীর  সেবা  করার  ব্যাপারে  অনুমতি  নিয়ে  এসেছে। আমি   বললাম,আললাহর কসম! আমি রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে কোন অনুমতি আনতে যাব না। জানি না যখন আমি এ ব্যাপারে অনুমতি চাইব,তখন রাসূলুলাল হ (সা:) কি বলবেন। কারণ আমি  একজন  যুবক। এভাবে আরো দশদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (সা:) আমাদের সাথে কথাবার্তা  বন্ধ করে দেওয়ার পর পঞ্চাশতম রাত্রিটিও অতিক্রম করল। ঐদিন সকালে ফজরের  ছালাত  আদায়  করলাম  এবং  আমাদের  এক  ঘরের  ছাদে বসেছিলাম, যে অবস্থার ব্যাপারে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন। মনে হচিছল,জীবন ধারণ আমার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে এবং পৃথিবী যেন তার সমস্ত বিস্তির্ণতা সত্ত্বেও আমার জন্য অত্যন্ত  সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। এমন সময় আমি সাল‘ পর্বতের উপর  উচ্চৈঃস্বরে চীৎকারকারী একজনের শব্দ শুনতে পেলাম। সে চীৎকার করে বলছে, হে কা‘ব বিন মালিক! সুসংবাদ গ্রহণ কর!

কা‘ব বলেন,আমি  আল্লাহর  দরবারে  সিজদায়  পড়ে  গেলাম। আমি অনুধাবন করতে পারলাম  যে,এবার সংকট কেটে গেছে। রাসূলুল্লাহ (সা:) ফজরের ছালাতের পর ঘোষণা করে দিয়েছিলেন  যে,আল্লাহ আমাদের তওবা কবুল করেছেন। কাজেই লোকেরা আমার ও আমার অপর দু’জন সাথীর কাছে সুসংবাদ দেওয়ার জন্য আসতে লাগল। একজন তো ঘোড়ায় চড়ে এক দৌড়ে  আমার কাছে আসলেন এবং আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তি দৌড়িয়ে পাহাড়ে উঠলেন। তার কথা  অশ্বারোহীর চেয়েও দ্রুততর হ’ল। যার শব্দ আমি শুনেছিলাম সে যখন আমার কাছে সুসংবাদ প্রদান করতে আসল,তখন সুসংবাদ দেয়ার প্রতিদান স্বরূপ আমার পোশাক জোড়া খুলে তাকে পরিয়ে দিলাম। আললাহর কসম! তখন আমার কাছে ঐ পোশাক জোড়া ছাড়া আর কোন কাপড় ছিল না। তারপর আমি এক জোড়া পোষাক ধার করে নিলাম এবং তা পরিধান করে রাসূল (সা:)-এর সাথে সাক্ষাতের নিমিত্তে বের হ’লাম। পথে দলে দলে লোকজন আমার সাথে সাক্ষাৎ করছিল এবং তওবা কবুল হওয়ার জন্য তারা আমাকে মুবারকবাদ জানাচিছল। তারা বলছিল, তোমার তওবা কবুল করে আল্লাহ্‌ তোমাকে যে পুরষ্কৃত করেছেন, এজন্য তোমাকে মুবারকবাদ। কা‘ব (রাঃ) বলেন, এভাবে আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম। সেখানে রাসূলুললাহ (সা:) লোকজন পরিবেষ্টিত হয়ে বসেছিলেন। ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ (রাঃ) আমাকে দেখে দৌড়ে এসে মুছাফাহা করলেন এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন। আল্লাহর কমস!  মুহাজিরদের  মধ্য  থেকে  সে  ব্যতীত  অন্য  কেউ  এভাবে  এসে আমাকে ধন্যবাদ জানায়নি। আমি কোনদিন তাঁর অনুগ্রহ ভুলব না।

কা‘ব (রাঃ) বলেন,তারপর আমি রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে সালাম দিলাম। তখন খুশীতে তাঁর চেহারা  উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। রাসূল (সা:) বললেন,(হে কা‘ব)! তোমার মা তোমাকে জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত  অতিক্রান্ত দিনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভাল দিনের সুসংবাদ গ্রহণ কর! কা‘ব বলেন, আমি বললাম,হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! এ (ক্ষমা) আপনার পক্ষ থেকে, না আল্লাহর পক্ষ থেকে? তিনি বললেন,না,এ তো আল্লাহর পক্ষ থেকে।

রাসূলুল্লাহ (সা:) যখন খুশী হ’তেন,তখন তাঁর চেহারা এক ফালি চাঁদের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠত। আমরা চেহারা দেখে তাঁর খুশী বুঝতে পারলাম। তারপর আমি তাঁর সামনে বসে বললাম,হে আললাহর রাসূল (সা:)! আমার তওবা কবুলের জন্য শুকরিয়া স্বরূপ  আমি আমার সমস্ত ধন-সম্পদ আল্লাহ ও রাসূলের পথে ছাদাক্বা করে দিতে চাই। রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন,তোমার  সম্পদের কিছু অংশ  নিজের জন্য রেখে দাও। তাতে তোমার কল্যাণ হবে। আমি বললাম, তাহ’লে আমি শুধু  খায়বারের অংশ টুকুই আমার জন্য রাখলাম। তারপর আমি বললাম,হে আললাহর রাসূল! আল্লাহ এবার সত্য কথা বলার কারণে আমাকে মুক্তি দিয়েছেন। কাজেই আমার এ তওবা কবুল হওয়ার কারণে আমি জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলোতে সত্য কথাই বলতে থাকব। আল্লাহর কসম! আমি জানি না,রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর কাছে সত্য কথা বলার কারণে সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত  আল্লাহ্‌ আমার প্রতি যে মেহেরবানী করেছেন,তেমনটি আর কোন মুসলমানের উপর করেছেন কি-না। আর রাসূল (সা:)-কে যেদিন থেকে এ কথা বলেছি,সেদিন থেকে সজ্ঞানে মিথ্যা কথা বলিনি। জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহ আমাকে মিথ্যা থেকে বাঁচাবেন বলে আশা করি।

আর আল্লাহ রাসূলুললাহ  (সা:)-এর  উপর  নিম্নোক্ত  আয়াত নাযিল করেছেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই অনুগ্রহপরায়ণ হ’লেন নবীর প্রতি এবং মুহাজির ও আনছারদের প্রতি যারা তার অনুসরণ করেছিল সংকটকালে- এমনকি যখন তাদের এ দলের চিত্ত-বৈকল্যের উপক্রম হয়েছিল। পরে আল্লাহ্‌ তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। তিনি তো তাদের প্রতি দয়ার্দ্র,পরম দয়ালু। এবং তিনি ক্ষমা করলেন অপর তিনজনকেও,যাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল,যে পর্যন্ত না পৃথিবী বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য তা সংকুচিত হয়েছিল  এবং তাদের জীবন তাদের জন্য দুর্বিষহ হয়েছিল এবং তারা উপলব্ধি করেছিল যা,আল্লাহ ব্যতীত কোন আশ্রয়স্থল নেই,তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন ব্যতীত,পরে তিনি তাদের তওবা কবুল করলেন যাতে তারা তওবায় স্থির থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের অন্তরভুক্ত হও।’ [তওবা ১১৭-১১৯]

আল্লাহর কসম! ইসলাম গ্রহন করার পর এর চাইতে উৎকৃষ্ট আর কোন অনুগ্রহ আল্লাহ আমার উপর করেননি যে,রাসূল (সা:)-এর সামনে সত্য বলার তাওফীক্ব দান করে আমাকে ধ্বংসের   হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে। অন্যথা অন্যান্য মিথ্যাবাদীদের মত আমিও ধ্বংস হয়ে যেতাম।  কারণ অহি যখন  নাযিল হচিছল (অর্থাৎ রাসূল (সা:)-এর জীবদ্দশায়), সে সময় যারা মিথ্যা বলেছিল তাদের সম্পর্কে আল্লাহ যে মারাত্মক কথা বলেছিলেন,তা আর কারো সম্পর্কে বলেননি।

মহান আল্লাহ্‌ বলেছিলেন, ‘তোমরা তাদের নিকট ফিরে আসলে অচিরেই তারা আল্লাহর শপথ করবে যাতে তোমরা তাদের  উপেক্ষা কর। সুতরাং তোমরা তাদেরকে উপেক্ষা করবে। তারা অপবিত্র এবং তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ জাহান্নাম তাদের আবাসস্থল। তারা তোমাদের নিকট শপথ করবে যাতে তোমরা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হও।তোমরা তাদের প্রতি তুষ্ট হ’লেও আল্লাহ তো সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের প্রতি তুষ্ট হবেন না’ [তওবা ৯৫-৯৬]।

কা‘ব (রাঃ) বলেন,আর আমরা তিনজন সেসব লোকদের থেকে  আলাদা,যারা তাদের যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে মিথ্যা শপথ করেছিল এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের   কথা মেনে নিয়ে তাদেরকে বায়‘আত করিয়েছিলেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু আমাদের ব্যাপারটি তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন (আললাহর উপর)। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ যে ব্যাপারে ফায়ছালা দিয়েছিলেন,সে ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, ‘সেই তিনজন, যারা পেছনে থেকে গিয়েছিল’ (তওবা ১১৮) ।

(অর্থাৎ আল্লাহ তাদেরকে মাফ করে দিয়েছিলেন)। যারা জেনে বুঝে জিহাদ থেকে পেছনে থেকে গিয়েছিল,তাদের কথা এখানে বলা হয়নি। বরং এখানে কেবল আমাদের (তিনজনের) কথা বলা হয়েছিল। আর যারা হলফ করেছিল ও ওযর পেশ করেছিল এবং তাদের ওযর রাসূল (ছাঃ) গ্রহণ করেছিলেন তাদের থেকে আমাদের ব্যাপারে ফায়ছালাটি পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল।

[ছহীহ বুখারী, হা/৪৪১৮ ‘মাগাযী’ অধ্যায়, ‘কা‘ব বিন মালিকের ঘটনা’ অনুচেছদ, মুসলিম হা/২৭৬৯, ‘তওবা’ অধ্যায়, অনুচেছদ-৯]

শিক্ষা:

  • সত্য কথা বিপদ থেকে মুক্তি দেয়।
  • কোন আনন্দের সংবাদে দিশেহারা না হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়  করা উচিৎ।
  • মুমিন ব্যক্তি তার কর্তব্য পালনে অবহেলা করলে ব্যথিত-মর্মাহত হয়।
  • মুমিন তার ভাইকে কখনো লাঞ্ছিত-অপদস্থ-অপমানিত করবে না, বরং তার মান-সম্মান রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট থাকবে।
  • মুমিন ব্যক্তি কোন প্রলোভনে পড়ে তার দ্বীন-ধর্মকে বিকিয়ে দিতে পারে না।
  • যদি মানুষ শয়তানী প্ররোচনায় পাপ করে ফেলে তাহলে সে তওবার মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হ’তে পারে।

হাদিসের গল্পঃ মুমিনের কারামত






বনী ইসরাঈলের জনৈক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তির নিকট এক হাযার স্বর্ণমুদ্রা কর্য চাইলে কর্যদাতা  বলল,কয়েকজন লোক নিয়ে আস,আমি তাদেরকে সাক্ষী রাখব। গ্রহীতা বলল,‘আল্লাহই সাক্ষী হিসাবে যথেষ্ট’। কর্যদাতা পুনরায় বলল,তবে একজন যামিনদার উপস্থিত কর! সে বলল, ‘আল্লাহই যামিনদার হিসাবে যথেষ্ট’।তখন কর্যদাতা বলল,তুমি ঠিকই বলেছ। তারপর সে নির্ধারিত সময়ে পরিশোধের শর্তে তাকে এক হাযার স্বর্ণমুদ্রা ধার দিল। অতঃপর সে (গ্রহীতা) সমুদ্রযাত্রা করল এবং তার (ব্যবসায়িক) প্রয়োজন পূরণ করল। পরিশোধের সময় ঘনিয়ে আসলে সে যানবাহন খুঁজতে লাগল,যাতে নির্ধারিত  সময়ে কর্যদাতার নিকট এসে পৌছাতে পারে। কিন্তু সে কোন যানবাহন পেল না। তখন সে এক টুকরো কাঠ নিয়ে তা ছিদ্র করল এবং কর্যদাতার নামে একখানা চিঠি ও এক হাযার দীনার ওর মধ্যে পুরে ছিদ্রটি বন্ধ করে দিল। তারপর ঐ কাষ্ঠখন্ডটা সমুদ্র তীরে নিয়ে গিয়ে বলল,‘হে আল্লাহ! তুমি তো জান,আমি অমুকের নিকট এক হাযার স্বর্ণমুদ্রা কর্য চাইলে সে আমার কাছ থেকে যামিনদার চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আল্লাহই যামিনদার হিসাবে যথেষ্ট। এতে সে রাযী হয়ে যায় (এবং আমাকে ধার দেয়)। তারপর সে আমার কাছে সাক্ষী চেয়েছিল,আমি বলেছিলাম,সাক্ষী হিসাবে আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট। তাতে সে রাযী হয়ে যায়। আমি তার প্রাপ্য তার নিকট পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যানবাহনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম, কিন্তু পেলাম না। আমি ঐ এক হাযার স্বর্ণমুদ্রা তোমার নিকট আমানত রাখছি। এই বলে সে কাষ্ঠখন্ডটা সমুদ্রবক্ষে নিক্ষেপ করল। তৎক্ষণাৎ তা সমুদ্রের মধ্যে ভেসে চলে গেল। অতঃপর লোকটি ফিরে গেল এবং নিজের শহরে যাওয়ার জন্য যানবাহন খুঁজতে লাগল।

 ওদিকে কর্যদাতা (নির্ধারিত দিনে) এ আশায় সমুদ্রতীরে গেল যে,হয়তবা ঋণগ্রহীতা তার পাওনা টাকা নিয়ে কোন নৌযানে চড়ে এসে পড়েছে। ঘটনাক্রমে ঐ কাষ্ঠখন্ডটা তার নযরে পড়ল,যার ভিতরে স্বর্ণমুদ্রা ছিল। সে তা পরিবারের জ্বালানির জন্য বাড়ী নিয়ে গেল। যখন কাঠের টুকরাটা চিরল,তখন ঐ স্বর্ণমুদ্রা ও চিঠিটা পেয়ে গেল। কিছুদিন পর ঋণগ্রহীতা এক হাযার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে (পাওনাদারের নিকট) এসে হাযির হ’ল। সে বলল,আললাহর কসম! আমি তোমার (প্রাপ্য) মাল  যথাসময়ে  পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যানবাহনের খোঁজে সর্বদা চেষ্টিত ছিলাম। কিন্তু যে জাহাযটিতে করে আমি এখন এসেছি এর আগে আর কোন জাহাযই পাইনি (তাই সময়মত আসতে পারলাম না)। কর্যদাতা বললেন,তুমি কি আমার নিকট কিছু পাঠিয়েছিলে? ঋণগ্রহীতা বলল, আমি তো তোমাকে বললামই যে,এর আগে আর কোন জাহাযই পাইনি। অতঃপর ঋণদাতা বলল,আল্লাহ পাক আমার নিকট তা পউছিয়েছেন,যা তুমি পত্রসহ কাষ্ঠখন্ডে পাঠিয়েছিলে। কাজেই এক হাযার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে আনন্দচিত্তে ফিরে যাও ।

[আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, ছহীহ বুখারী হা/২২৯১, ‘যামিন হওয়া’ অধ্যায়, অনুচেছদ-১]।

শিক্ষা :

  • সর্বদা আল্লাহর উপর অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা প্রকৃত মুমিনের অন্যতম গুণ।
  • বিনা সূদে ‘করযে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ প্রদানের বহুগুণ প্রতিদান রয়েছে (বাকবারাহ ২৪৫)।
  • নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ পরিশোধের জন্য ঋণগ্রহীতা যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন
  • ঋণ পরিশোধের সদিচছা থাকলে আল্লাহ্‌ পাক তার ব্যবস্থা করে দেন।
Source: quraneralo.com

হাদিসের গল্পঃ দোলনায় কথা বলা তিন শিশু






আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন,(বনী ইসরাঈলের মধ্যে) তিন ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই দোলনায় কথা বলেনি।

(১) ঈসা ইবনে মারইয়াম: মারইয়াম (আঃ)-এর গর্ভে ঈসা (আঃ) অলৌকিক ভাবে জন্মগ্রহণ  করলে লোকজন তার ব্যাপারে সন্দিহান হ’ল। তখন মারইয়াম (আঃ)-এর ইঙ্গিতে ঈসা (আঃ)   তাঁর মাতার পক্ষ থেকে জবাব  দিয়ে  বললেন,‘আমি  আল্লাহর  দাস।  তিনি  আমাকে  কিতাব  (ইনজীল) প্রদান করেছেন এবং আমাকে নবী করেছেন’। ‘আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে জোরালো নিদের্শ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি,ততদিন ছালাত ও যাকাত আদায় করতে এবং আমার মায়ের অনুগত থাকতে। আল্লাহ আমাকে উদ্ধত ও  হতভাগা করেননি’। ‘আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জনমগ্রহণ করেছি,যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন জীবিত পুনরুত্থিত হব’ [মারিয়াম ১৯/২৯-৩৩)]।   

(২) ছাহেবে জুরাইজ (জুরাইজের সাথে সংশিলষ্ট একটি বাচচা): জুরাইজ একজন আবেদ বান্দা  ছিলেন। তিনি নিজের জন্য একটি ইবাদতগাহ তৈরী করলেন। তিনি সেখানে থাকা অবস্থায় একদিন তার মা সেখানে আসলেন। এ সময় তিনি ছালাতে রত ছিলেন। তার মা বললেন, ‘হে জুরাইজ! তখন তিনি (মনে মনে) বলেন,‘হে প্রভু! একদিকে আমার ছালাত আর অন্যদিকে আমার মা’। জুরাইজ ছালাতেই রত থাকলেন। তার মা চলে গেলেন।পরবর্তী দিন তার মা আসলেন । এবারও তিনি ছালাতে মগ্ন ছিলেন। তার মা তাকে ডাকলেন,‘হে জুরাইজ’! তিনি (মনে মনে) বলেন,‘হে প্রভু! একদিকে আমার ছালাত আর অন্যদিকে আমার মা’। তিনি তার ছালাতেই ব্যস্ত থাকলেন। এভাবে তৃতীয় দিনেও জুরাইজ একই কাজ করলে তার মা বললেন, ‘হে আল্লাহ! একে তুমি যেনাকারী নারীর মুখ না দেখা পর্যন্ত মৃত্যু দিও না’।

বনী ইসরাঈলের মধ্যে জুরাইজ ও তার ইবাদতের কথা আলোচিত হ’তে লাগল। এক ব্যভিচারী  নারী  ছিল। সে উলেলখযোগ্য  রূপ-সৌন্দযের্র অধিকারিণী ছিল। সে বলল,তোমরা যদি চাও,  আমি তাকে (জুরাইজ) বিভ্রান্ত  করতে পারি। সে তাকে ফুসলাতে লাগল,কিন্তু তিনি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করলেন না। অতঃপর সে তার ইবাদতগাহের কাছাকাছি এলাকায় এক রাখালের কাছে আসল। সে নিজের উপর তাকে অধিকার দিল এবং উভয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত হ’ল। এতে সে গর্ভবতী হ’ল। সে বাচচা প্রসব করে বলল, এটা জুরাইজের সন্তান। বনী ইসরাঈল (ক্ষিপ্ত হয়ে)  তার কাছে এসে তাকে ইবাদতগাহ থেকে বের করে আনল,তার ইবাদতগাহ ধূলিসাৎ করে দিল এবং তাকে মারধর করতে লাগল।

জুরাইজ বললেন,তোমাদের কি হয়েছে? তারা বলল,তুমি এই নষ্টা মহিলার সাথে যেনা করেছ। ফলে একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তিনি বললেন,শিশুটি কোথায়?তারা শিশুটিকে নিয়ে আসল। জুরাইজ বললেন,আমাকে একটু সুযোগ দাও ছালাত আদায় করে নেই। তিনি ছালাত আদায় করলেন। ছালাত শেষ করে তিনি শিশুটির কাছে এসে তার পেটে খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করলেন,‘এই শিশু! তোমার পিতা কে’? সে বলল,‘আমার পিতা অমুক রাখাল’। উপস্থিত লোকেরা তখন জুরাইজের নিকটে এসে তাকে চুম্বন করতে লাগল এবং তার শরীরে হাত বুলাতে লাগল। আর তারা বলল,এখন আমরা তোমার ইবাদতগাহটি সোনা দিয়ে তেরী করে দিচিছ। তিনি বললেন,দরকার নেই,বরং পূর্বের মত মাটি দিয়েই তৈরী করে দাও। অতঃপর তারা তাই করল।

(৩) একটি শিশু তার মায়ের দুধ পান করছিল। এমন সময় একটি লোকদ্রুতগামী ও উন্নত মানের একটি পশুতে সওয়ার হয়ে সেখান দিয়ে যাচিছল। তার পোষাক-পরিচছদ ছিল উন্নত। শিশুটির মা বলল,‘হে আল্লাহ! আমার ছেলেটিকে এই ব্যক্তির মত যোগ্য কর’। শিশুটি দুধ পান ছেড়ে দিয়ে লোকটির দিকে এগিয়ে এসে তাকে দেখতে লাগল। অতঃপর বলল,‘হে আল্লাহ! আমাকে এই ব্যক্তির মত কর না’। অতঃপর ফিরে এসে পুনরায় মায়ের দুধ পান করতে লাগল। (বর্ণনাকারী বলেন) আমি যেন এখনও দেখছি রাসূলুল্লাহ (সা:) শিশুটির দুধ পানের চিত্র তুলে  ধরছেন এবং নিজের তর্জনী মুখে দিয়ে চুষছেন। তিনি বলেন,লোকেরা একটি বাঁদিকে মারতে মারতে নিয়ে যাচিছল। আর বলছিল, তুমি যেনা করেছ এবং চুরি করেছ। মেয়ে লোকটি বলছিল,‘আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই আমার উত্তম অভিভাবক’। শিশুটির মা বলল, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার সন্তানকে এই নষ্টা নারীর মত কর না’। শিশুটি দুধ পান ছেড়ে দিয়ে  মেয়েটির দিকে তাকাল,অতঃপর বলল,‘হে আল্লাহ!

তুমি আমাকে এই নারীর মত কর’ এ সময় মা ও শিশুটির মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। মা বলল,হায়দুর্ভাগা! একটি সুশ্রী লোক চলে যাওয়ার সময় আমি বললাম,হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে এরূপ যোগ্য করে দাও’। তুমি  প্রত্যুত্তরে বললে,‘হে আল্লাহ্‌! আমাকে এর মত কর না’। আবার এই ক্রীতদাসীকে লোকেরা মারধর করতে করতে নিয়ে যাচেছ এবং বলছে,তুমি যেনা করেছ এবং চুরি করেছ। আমি বললাম,‘হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে এরূপ কর না’। আর তুমি বললে,‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে এরূপ কর’। শিশুটি এবার জবাব দিল,প্রথম ব্যক্তি ছিল সৈরাচারী যালেম।সেজন্যই আমি  বললাম,‘হে আল্লাহ! আমাকে এ ব্যক্তির মত কর না। আর এই মহিলাটিকে তারা বলল,তুমি যেনা করেছ। প্রকৃতপক্ষে সে যেনা করেনি। তারা বলছিল,তুমি চুরি করেছ। আসলে সে চুরি করেনি। এজন্যই আমি বললাম,‘হে আল্লাহ! আমাকে এই মেয়ে লোকটির মত কর’

[বুখারী হা/৩৪৩৬ ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায়, অনুচেছদ-৪৮, হা/২৪৮২ ‘মাযালিম’ অধ্যায়, অনুচেছদ-৩৫; মুসলিম হা/২৫৫০ ‘সদ্ব্যবহার ও শিষ্টাচার’ অধ্যায়, অনুচেছদ-২]

শিক্ষা:

  • আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা থাকলে কেউ পদস্খলন ঘটাতে পারবে না।
  • কোন হক্বপন্থী ব্যক্তির বিরুদ্ধে যতই ষড়যন্ত্র করা হোক না কেন, তা একদিন সত্যরূপে প্রকাশিত হবেই এবং ষড়যন্ত্রকারীরা লজ্জিত হবে।
  • আমরা যাকে ভাল মনে করি,প্রকৃতপক্ষে সে ভাল নাও হ’তে পারে।
  • পক্ষান্তরে যাকে খারাপ মনে করি,প্রকৃতপক্ষে সে খারাপ নাও হ’তে পারে।
  • সর্বদা পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে হবে।
Source: quraneralo.com
Copyright © 2013 Top 10 Softwares and Blogger Themes.